প্রতি বছর লাখও মুসলমান ইসলামের আহকাম পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে ছুটে যান দূর আরবে। হজের নানা আহকামে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মধ্যকার অকৃত্রিম সম্পর্কের পরিচয় যেমন ফুটে উঠে তেমনি স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ পায়। আল্লাহর ঘরের মেহমানরা যখন সেলাইবিহীন এক প্রস্ত শুভ্র কাপড়ে জড়িয়ে ইহরাম বাঁধেন তখন তা তাদেরকে নিত্যদিনের সাজসজ্জা ও চাকচিক্যের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায় প্রেম ও বিশ্বাসের নতুন জগতে। হজের প্রতিটি আহকামে হাজী সাহেবরা তাদের নিটোল, নিষ্কলুষ ও অকৃত্রিম প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। প্রতিটি মুহূর্তে নিজের তপ্ত হৃদয় থেকে উৎসারিত কাতর প্রার্থনা জানান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে। তার প্রেমআকুতি গ্রহণের, তাকে আপন করে নেয়ার মিনতি জানান। প্রেমিক যেমন তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে গোপন অভিসারে মিলিত হওয়ার দুর্বার স্পৃহা ও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে, তেমনি হাজী সাহেবরাও তাদের মাওলায়ে হাকীকির প্রেমে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত ও মাতোয়ারা হয়ে ছুটে চলেন মক্কার আনাচে-কানাচে।
মানুষ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। আবেগের তোড়ে ভেসে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বাস্তবতার কঠিন কষাঘাতে বাঁধা পড়ে যায়। হজের সফরের পুরোটা সময়ই একজন হাজী আবেগের ফানুস উড়িয়ে হেজাজভূমিতে বিচরণ করেন। কিন্তু সাড়ে তিন হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে এদেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের ফানুস আস্তে আস্তে ফুটো হতে থাকে। জীবন-জীবিকার বাস্তব দুনিয়ায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেই আবেগ ও অপূর্ব আবহে ধোয়া অনুভূতির কথা ভুলতে থাকেন। এক সময় গতানুগতিক জীবনধারায় নিজেকে সঁপে দেন। তবে যাদের সৌভাগ্য হয়েছে পবিত্র ভূমিতে পা রাখার, কালো গিলাফ আর সবুজ গম্বুজের ছায়া মাড়ানোর তাদের জন্য সেই প্রেমানুভূতি সবসময়ই জাগিয়ে রাখা উচিত। একজন সাধারণ মানুষ আর আল্লাহর ও নবীজীর পবিত্র ঘর জেয়ারতকারীর আচরণ একরকম হওয়া কখনও কাম্য নয়। এজন্য হাদিসে বলা হয়েছে, হজপরবর্তী জীবনের ওপর নির্ভর করে হজ কবুল হওয়া না হওয়ার বিষয়টি। যারা হজ থেকে ফিরে এসে তাদের জীবনধারা পাল্টে দেন, এর ওপর অটল থাকেন তাদের হজ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর যারা হজ থেকে ফিরে এসে ‘যেই সেই’ তাদের হজের কবুলিয়তের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ থাকে।
দুই.
হজপরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। হজফেরত মানুষেরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ-এমন আশ্বাস হাদিসে দেয়া হয়েছে। সুতরাং যারা হজ থেকে ফিরে আসেন তাদের জীবন শুরু হয় নতুন করে। হজ থেকে ফিরে আসা মানে ইব্রাহিমী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোহাম্মদী প্রেমের বাণী নিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া। অনেকে মনে করেন, হজ থেকে ফিরে আসার পর চল্লিশ দিন ভালোভাবে চলতে হবে, পরে যেভাবে খুশি সেভাবেই চলা যাবে। এটা ভুল ধারণা। হজে যাওয়ার আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে গোনাহমুক্ত জীবন গঠনের। হজ থেকে ফিরে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, কোনো অন্যায়-অনাচারের ধারে-কাছেও যাওয়া যাবে না। আগের ক্লেদাক্ত জীবনধারার কথা পুরোটা ভুলে গিয়ে নতুন করে স্বচ্ছ ও নির্মল জীবন গড়ে তুলতে হবে। যাদের অসততা, দুর্নীতি ও অন্যায় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে তাদের সবকিছু থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ-রাসূলের সান্নিধ্যে ধন্য একজন মুমিনের জীবনধারা যেমন হওয়া উচিত সেভাবেই চলতে হবে প্রত্যেক হাজী সাহেবকে।
হাজী সাহেবরা ইহরামের সময় সাদা সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় গায়ে দেন। এটা একদিকে অহংবোধ দূর করে অপরদিকে মৃত্যুর সময়ের কাফন পরার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাজী সাহেবরা এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহর আইন ছাড়া কারও আইন মেনে চলবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদে সমগ্র জীবনধারা পরিচালনা করার শপথ নেন। হজ থেকে ফিরে আসার পরও এ ধারণাগুলো খেয়াল রাখতে হবে। হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বায়তুল্লাহ শরিফ ও রওজা মোবারক জিয়ারতের যে নেয়ামত আল্লাহ দান করেছেন তা হাজী সাহেবকে ভুলে গেলে চলবে না। উদাসীন হয়ে ক্রীড়াকৌতুক, খেল-তামাশা ও পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে অকৃতজ্ঞ হওয়া যাবে না। কারণ মাবরুর হজের নিদর্শন হলো হজ থেকে ফিরে এসে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত এবং আখেরাতের জন্য আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে ওঠা।
হজ করে এসে যার তার কাছে তা বলে বেড়ানো সমীচীন নয়। কারণ তাতে মনে লৌকিকতা ও অহংকার জেগে উঠতে পারে। হজে যে টাকা-পয়সা ব্যয় হয়েছে তা উল্লেখ করে আফসোস ও গল্প বাঞ্ছনীয় নয়। হজের নাম দিয়ে হাজী সাহেব সেজে রোজগার করার ধান্দাও একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। হজ থেকে ফিরে কেউ নিজেকে আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যশীল, কল্যাণের প্রতি অনুরাগী, দ্বীনের প্রতি দৃঢ়, অপরাধ ও গোনাহ থেকে দূরে অবস্থানকারী হিসেবে পেলে তিনি খুবই সৌভাগ্যবান। পক্ষান্তরে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে পিছপা, কল্যাণের কাজ থেকে বিমুখ, অপরাধের প্রতি প্রত্যাবর্তনকারী ও গোনাহের কাজে অগ্রণী পেলে তা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।
হজের সফরে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত থাকেন হাজী সাহেবরা। ‘প্রভু হে বান্দা হাজির’ বলে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। আল্লাহর দরবারে হাজির থাকার এই যে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার তা শুধু হজের দিনগুলোতে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। হজ থেকে ফিরে এসে জীবনের প্রতিটি পদে পদে ‘লাব্বাইক’ কথাটির তাৎপর্য সামনে রাখতে হবে। মৃত্যু পর্যন্ত এই অঙ্গীকার থেকে সরে আসা যাবে না। কেউ নিজেকে আল্লাহর সামনে সমর্পণ করলে তার দ্বারা কোনো অন্যায়-অপকর্ম হতে পারে না। হাজী সাহেবদের দ্বারাও তা হওয়া উচিত নয়।
সদ্য যারা হজফেরত তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। তাদের গায়ে লেগে থাকে মক্কা-মদিনার সুবাস। দেশে ফেরার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত সে সুবাস অব্যাহত থাকে। এজন্য হাদিসে হাজীদের সঙ্গে সালাম-মুসাফাহার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কোনো হাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাকে সালাম দেবে। তার সঙ্গে মুসাফাহা ও মুআনাকা করবে এবং দোয়ার আবেদন করবে যেন তিনি বাড়িতে যাওয়ার আগে তোমার জন্য দোয়া করেন। কারণ কবুল হজকারীর সব পাপ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। যেহেতু হজ পালনকারীরা এত সম্মানী এজন্য তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যও বেশি। জীবনে নিষ্পাপতার ছাপ ধরে রাখাই তাদের প্রধান দায়িত্ব।
Very nice. Thanks.