সারল্যে ভরা দরদী অভিভাবক

44483_1552269934766_7898981_nসম্ভবত ২০০৫ সালে মাদরাসা দারুর রাশাদেই তাঁকে প্রথম দেখি। আমরা তখন সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী এডুকেশন সেন্টারের ছাত্র। আমাদের উদ্দেশে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন। কথায় ছিল দরদ। ছিল প্রচণ্ড আবেগ ও জ্বলন। এর কিছুদিন পর আরজাবাদ মাদরাসায় রাবেতা আদবে ইসলামীর একটি সাহিত্য সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন। আমি ওই সাহিত্য সভায় একটি লেখা পাঠ করেছিলাম। লেখাটি ছিল ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখের ওপর। লেখাটি তাঁর মনোযোগ কেড়েছিল। পাঠ করার পর খুটিয়ে খুটিয়ে পুরো লেখাটি তিনি পড়লেন। লাল কলম নিয়ে পুরোটা লেখা কাটাছেঁড়াও করলেন। তাঁর বক্তব্যের অনেকটা জুড়েই ছিল আমার ওই লেখাটির আলোচনা ও সমালোচনা।

প্রথমে তিনি লেখাটির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। লেখাটিতে বানানগত কিছু সমস্যা ছিল। তিনি সবগুলো চিহ্নিত করে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যটি ছিল এমন-‘যে তরুণ এতো ভালো লিখতে পারে তার বানানের এই সমস্যা কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না।’সত্যি কথা বলতে কী, মাওলানা ওমর আলীর সেদিনের সমালোচনার পরই আমি বানানের ব্যাপারে সচেতন হই। তাঁর ধরে দেয়া কিছু বানান আজও যখন আমার সামনে আসে তাঁর কথা স্মরণ করি। আমার লেখালেখির জীবনে তিনি সেদিন বড় ধরনের উপকার করেছিলেন।

এরপর থেকেই আমি তাঁর একজন ভক্ত। তিনিও আমাকে চিনে ফেললেন। দারুর রাশাদে যখন আসতেন তাঁর থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতাম। কোথাও দেখা হলে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে উৎসাহ দিতেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশ করতেন। আমি লক্ষ্য করেছি, তরুণদের প্রতি তাঁর একটা বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে। যখন কোনো তরুণ তাঁর কাছে যেত তিনি শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সময় দিতেন। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। তাঁর এত একজন বড়মাপের মানুষের কাছে তরুণদের এ প্রশ্রয়টা ছিল বড় ধরনের প্রাপ্তি। আমার জানামতে অনেক তরুণ তাঁর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে, তাঁর নির্দেশনায় বড় ধরনের অগ্রগতি সাধন করেছে। এমনকি তরুণরা কোথাও দাওয়াত করলে তিনি স্বাচ্ছন্দে গিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। তরুণদের নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথাও বেশ কয়েকবার তাঁর মুখ থেকে শুনেছি।

DSC04054

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের নলতা এলাকা পরিদর্শনে আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী রহ.।

আবু সাঈদ ওমর আলীকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয় ২০০৭ সালে। মাদরাসা দারুর রাশাদের প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের নলতায়। তাঁর বাড়ির মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল উপলক্ষে প্রতি বছর ঢাকা থেকে অনেকেই যান। সে বার মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী, মাওলানা আব্দুর রাযযাক নদভী, মাওলানা আব্দুর রহীম ইসলামাবাদীসহ ওলামায়ে কেরামের একটি দাওয়াতি টিম সেখানে গিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সুন্দরবন সফর ছাড়াও উদ্দেশ্য ছিল উপকূলীয় এলাকায় কিছু দাওয়াতি কার্যক্রম। কারণ, সুন্দরবনের কাছের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে খ্রিস্টান মিশনারীরা জোরেশোরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রলোভনে লোকদেরকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করছে।

মসজিদ মিশনের মাধ্যমে ওমর আলী সাহেব আগে থেকেই ওই দাওয়াতি প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছিলেন। সুন্দরবন সফর শেষে পুরোটা সময় তিনি দাওয়াতি কাজে ব্যয় করেন। মসজিদ মিশনের স্থানীয় কর্মীরা প্রায় চূড়ান্ত করে রেখেছিলেন সেখানকার একটি হিন্দু পরিবার ওমর আলী সাহেবের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামে দীক্ষিত হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে ওই পরিবারটি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার সাহস করেনি। এছাড়াও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে পারে এমন লোকদেরকে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয়ে থাকার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টায় আমরা যুগপৎ বিস্মিত ও উদ্দীপ্ত হয়েছি।

সুন্দরবন সফরে নৌকায় উঠছেন আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী রহ.।

সুন্দরবন সফরে নৌকায় উঠছেন আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী রহ.।

ঢাকা থেকে সফর শুরু করা থেকে নিয়ে তিনদিনের সফরের পুরোটা জুড়েই আমি ওমর আলী সাহেবের কাছাকাছি ছিলাম। দূর থেকে তাঁর ব্যক্তিত্ব যতটা না আমার কাছে ধরা পড়েছিল তার চেয়ে অনেক বড়মাপের একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ মনে হয়েছে এই কাছে ভেড়ার পর। অতি সাদাসিধে চাল-চলন। অমায়িক তাঁর আচরণ। সবার সঙ্গে হাসি-খুশি, খোলামেলা কথাবার্তা বলছেন। তাঁর প্রতিটি কথায় দীনী আবেগ ও দরদ ফুটে উঠত। চলার পথেও তিনি মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলেছেন যা আমাদের জীবনের পাথেয় হওয়ার এত। স্থানীয় ওলামায়ে কেরামের উদ্দেশে তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। আবেগঝরা, তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর সেই ভাষণটি আজও আমার হৃদয়কোণে উঁকি দেয়।

মাওলানা আবু সাঈদ ওমর আলী ছিলেন তরুণদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী। যে তরুণের মধ্যে তিনি সম্ভাবনা দেখতেন তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তাঁর আশ্রয়ে ও নির্দেশনা পেয়ে কত তরুণ যে লেখালেখি ও সৃজনশীলতার আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার এর কোনো হিসাব নেই। তিনি অকাতরে তরুণদের প্রশংসা করতেন। তারুণ্যের মধ্যে জাগরণ তাঁকে উদ্দীপ্ত করতো। শুধু তরুণই না, যার মধ্যে যে যোগ্যতা তিনি দেখতেন তাকে অগ্রসর করার যাবতীয় প্রচেষ্টা তাঁর ছিল। আমাদের দারুর রাশাদ মাদরাসার ফারেগীন ছাত্রদের সংগঠন আর রাশাদ ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে প্রতি বছর তিনি আসতেন এবং প্রেরণাধর্মী ও সচেতনমূলক ভাষণ দিতেন। তাঁর ভাষণে সবাই পথচলার খোরাক পেতো।

আজ আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী আর নেই। ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে দীনের মিশন নিয়ে তাঁকে আর ছুটে যেতে দেখা যাবে না। তবে তিনি যে মিশন চালু করে গেছেন, সে মিশন এগিয়ে নেয়ার মতো লোকের আজ বড়ই প্রয়োজন। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের নূর দিয়ে ভরপুর করে দিন। আমীন।

 

Related posts

*

*

Top