হিজরী সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়। এশিয়ার বিস্ত্রীর্ণ এলাকাজুড়ে অভ্যুদয় ঘটে বর্বর তাতারীদের। তাদের হিংস্র থাবায় খলীফা হারুনুর রশীদের বাগদাদ নগরী পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। মূর্তিমান অভিশাপরূপে মুসলমানদের ওপর চড়াও হয় বর্বর এই জাতি। এত বড় বিপর্যয় ইতঃপূর্বে মুসলমানদের ওপর আরোপিত হয়নি। সবার মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা হয়ত আর কোনোদিন সম্ভব হবে না। কিন্তু না, কিছুদিন যেতে না যেতেই নির্মম, নিষ্ঠুর, পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী সেই তারীরাই আশ্রয় নেয় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। এক সময় আলমে ইসলামীর জন্য যারা ছিল মূর্তিমান অভিশাপ, চরম শত্রু, পরবর্তীকালে তারাই কিভাবে হলো দ্বীন ইসলামের শক্তিশালী রক্ষক ও মুহাফিজ-সেটা এক মহাবিস্ময়। ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণ করলে বিস্ময়কর এই পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ পাওয়া যায়। তবে মোটাদাগে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ ছিল তৎকালীন মুসলিম দাঈদের ক্ষুরধার লিখনি ও প্রভাবক সাহিত্য। তাদের রচিত ইসলামী সাহিত্যই সে সময় সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিল।
ইতিহাসের বাঁক ঘুরে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে একটু নজর দিন। উড়ে এসে জুড়ে বসা ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী প্রায় দুশ বছর পর্যন্ত পরাধীনতার নাগপাশ পরিয়ে হরণ করে নেয় এদেশের মানুষের সব অধিকার। টিপু সুলতান রহ. এর সামরিক অভিযানে ব্যর্থতা, ঐতিহাসিক বালাকোটের প্রান্তরে মুজাহিদদের করুণ পরিণতি মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করে চরম হতাশার। মুসলমানদের অন্তরে সৃষ্ট সেই ক্ষত সহজে শুকিয়ে যাবার ছিল না। সম্মুখ সমরে বিপর্যস্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দ সংকটময় সেই মুহূর্তে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দানে গভীর মনোনিবেশন করেন। মুসলমানদের মনোবল ও জাগরণী স্পৃহা সতেজ রাখতে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা পালন করেন জোরালো ভূমিকা। ইংরেজদের খরগহস্ত উপেক্ষা করে চালিয়ে যান তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগ্রাম। তাদের মুখে ও কলমে অনবরত ঝরাতে থাকেন স্পৃহার বারুদ। লেখক তার লিখনিকে, সাহিত্যিক তার সাহিত্যকে গ্রহণ করেন অস্ত্র হিসেবে। আল্লামা শিবলি নোমানী রহ. এর লেখার ফাঁকে ফাঁকে, দেশাত্মবোধক কবিতার ছন্দে ছন্দে, আকবর ইলাহাবাদীর প্রতিটি পংক্তিতে, মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য, উত্থান-পতনের চিত্রাকর কবি হালির কবিতায় এর বেশ প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লামা ইকবাল, ডেপুটি নজির আহমদ, যফর আলী খান, মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহরের পদ্য ও গদ্যের শব্দে শব্দে সেই ঝঙ্কার ভেসে ওঠে। তাদের লিখনি বা সাহিত্য ওই সময় ব্যথিত হৃদয়ে বুলিয়েছিল সান্ত¦নার পরশ। প্রেরণা যুগিয়েছিল নতুন করে জেগে ওঠার। ইসলামী বীরত্বগাথার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দ্বারা যুবকদের রক্তে সৃষ্টি হয়েছিল স্পৃহার অগ্নিবারুদ। মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তরে জাগরূক সেই প্রেরণা ও উজ্জীবনের ফসলই এদেশের স্বাধীনতা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের ধারালো কলমের বিপ্লবী ভূমিকার কথা ইতিহাসে সযতনে রক্ষিত আছে। যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সেই অধ্যায়টি অনাগতদের প্রেরণার অনন্য উৎস হয়ে থাকবে।
দুই.
লেখালেখি, লেখ্য সাহিত্য বা লিখনির প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী ও শক্তিশালী হতে পারে উপরে তার একটি ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। শিল্প-সাহিত্যের এই অঙ্গনটি বরাবরই শক্তির আধার। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে এ শক্তিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। সময়ের পটপরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সামরিক শক্তির মহড়া দিয়ে দেশ দখলের রেওয়াজ খুব একটা নেই। বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও তাদের সামরিক শক্তিকে যতটা না কাজে লাগাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করছে শিল্প-সাহিত্যের এই অঙ্গনটিতে। বুদ্ধিবৃত্তিক এই লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য তারা আবিষ্কার করছে নিত্য-নতুন কৌশল। বর্তমান বিশ্বে একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, লাখ লাখ সৈন্য যা না করতে পারে তা দু’চারটি প্রচার মিডিয়া ও পত্রিকা দ্বারা করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বটাকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া। মিডিয়ার অফুরন্ত শক্তির দ্বারাই বিশ্ব তাগুতি শক্তি প্রতিনিয়ত মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও শাশ্বত মূল্যবোধে আঘাত হানছে। শৈল্পিক মিশেলের কারণে তাদের সেই আঘাত অধিক ক্রিয়াশীল। বারবার একটি মিথ্যা ও বানোয়াট বিষয়কে বিচিত্র আঙ্গিকে উপস্থাপনের ফলে মিথ্যাটিই জনসাধারণের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনের দিকে তাকালে নষ্ট ধারার প্রাধান্যই নজরে আসবে। বোধ ও বিশ্বাসে যারা আবিলতা লালন করে, তারাই এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। তাদের সৃষ্টিকে তারা সহজাত ও বাঞ্ছিত ধারার বিপরীতে নিপুণভাবে উপস্থাপন করছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বাসী মানুষেরা চিহ্নিত এই গোষ্ঠীর বলয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে। ফলে তাদের উৎপাদিত পণ্যকেই নিত্যসামগ্রীর তালিকায় স্থান দিচ্ছে। মনঃপূত না হলেও তাদের সৃষ্টিকেই লুফে নিতে হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ওপর বহমান এ বিপরীত ধারাটি ততটা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারেনি। বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কাছে যাদের দায়বদ্ধতা আছে তারা এমন কোনো বলয় গড়ে তুলতে পারেননি যাতে তারা প্রত্যয়দীপ্ত ও সুদৃঢ়। তাদের এই অক্ষমতা কিংবা হেয়ালীপনা ক্ষতির পাল্লাকে দিন দিন শুধু ভারী করে তুলছে। যারা আদর্শকে লালন করতে চায়, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ যাদের প্রত্যাশিত-তারা এমন কোনো শক্তিশালী ঠিকানা পাচ্ছেন না যাতে আশ্রয় নিতে পারেন, যার প্রতি আস্থাশীল হতে পারেন। এই পারা-না পারার দায়বোধ প্রত্যেকের ভেতরে জাগরূক রাখলে উত্তরণের সুবাতাস বইতে পারে।
তিন.
লেখালেখি, শিল্প-সাহিত্য, মিডিয়া-সবগুলোই গণসচেতনতা এবং চিন্তাধারা পরিবর্তনের অতি প্রভাবক মাধ্যম। এগুলোর কোনোটিই আজ বিশ্বাস ও আদর্শের আনুকূল্যে হচ্ছে না। সাধারণ জনগোষ্ঠীসংশ্লিষ্ট এসব মাধ্যম থেকে আমরা দূরে ছিটকে পড়ার কারণে জাতীয় ও সামাজিক পরিম-লে আমাদের কর্তৃত্ব শূন্যের কোঠায়। এ দৃশ্যপট কারো জন্যই সুখকর নয়। চলমান ভঙ্গুর এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। সভ্যতার শিকড়গাথা ও সামাজিক সুস্থ ধারা বিনির্মাণের লক্ষ্যেই সুস্থ ও শালীন ধারার চর্চা আরো গতিশীল হওয়া প্রয়োজন। অনিবার্য এই প্রয়োজনের তাগিদেই এতে গতি সঞ্চালন করতে হবে। আর এর জন্য প্রধানত জাতির অভিভাবক ওলামায়ে কেরামকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ অঙ্গনের নেতৃত্বভার তাদেরই গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত লেখালেখির বিস্তৃত সোনালী প্রান্তর আজ আলেম সমাজের জন্য উম্মুখ হয়ে আছে। এ অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণা তাদের নেতৃত্বের ক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ খ্যাত সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেছেন, ‘লেখনির এক অদ্ভুত প্রভাব সৃষ্টিকারী ক্ষমতা রয়েছে। লেখনির মাধ্যমে লেখকের ভাব-অনুভূতি এমনকি তার হৃদয়ের স্পন্দনও পাঠকের মধ্যে সংক্রমিত হয়। অনেক সময় হয়ত তা অনুধাবনও করতে পারেন না। ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান লেখকের লিখনি পাঠকের অন্তরেও সৃষ্টি করে বিদ্যুৎপ্রবাহ।’ মুসলমানদের শিক্ষার সূচনা কলমের মাধ্যমে। কলমই তাদের বলিষ্ঠ বাহন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে যেদিন থেকে মুসলমানেরা কলম ছেড়ে দিয়েছে সেদিন থেকে তারা দুর্গতির শিকার হয়েছে। একজন মুসলমান ও ঈমানদারের লেখাও ইবাদততুল্য। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুসলমান তার অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্য যদি এক অক্ষর লিখে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে একটি মুদ্রা ও একটি গোলাম আযাদ করার সওয়াব দেবেন।’ সময়ের ভাষায় যারা দ্বীনকে উপস্থাপন করতে চান তাদের জন্য লিখনি হচ্ছে ‘কাশাজারাতিন তায়্যিবাতিন’(পবিত্র বৃক্ষের মতো) যার শিকড় জমিনের গভীরে প্রোথিত এবং ডালপালা আকাশে বিস্তৃত।’
সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতার দাবি পূরণ করতে হলে আলেম সমাজকে ব্যাপকভাবে কলম হাতে তুলে নিতে হবে। আগামী দিনের কলম যুদ্ধে তাদের অবতীর্ণ হতে হবে বীরের বেশে। শাশ্বত বিশ্বাস ও লালিত আদর্শের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এরচেয়ে শক্তিশালী, কার্যকর, ফলপ্রসূ কোনো হাতিয়ার নেই।