জহির উদ্দিন বাবর
ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা অনেক বর্বরতা ও নৃশংসতার কথা পাই। হিটলার, মুসোলিনি, হালাকু খান কিংবা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নৃশংস আচরণের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। কারবালা, স্পেন, হিরোশিমা-নাগাসাকি ট্রাজেডি কিংবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা ব্যাপক আলোচিত। কিন্তু সব ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বর্বরতা। সেখানকার প্রাচীন অধিবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মাসখানেক ধরে যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চলছে এর কাছে অতীতের সব বর্বরতা ও নৃশংসতা ম্লান হয়ে গেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এতো বীভৎস চিত্র আর কেউ দেখেনি। মানুষ এতো হিংস্র হতে পারে সেটা মিয়ানমারের অসভ্য সেনাদের না দেখলে পৃথিবীবাসী বুঝতে পারতো না। সেখানে যা ঘটছে এর সিকি ভাগও গণমাধ্যমে আসছে না। যা আসছে তাতেই অসভ্যতার সব মাত্রা ছাড়িয়েছে মিয়ানমার সরকার। তথাকথিত সভ্য পৃথিবীতে এমন অসভ্যতা সত্ত্বেও মানবতার দাবিদার বিশ্ব মোড়লেরা মুখে কুলুক এঁটে বসে আছে। রাখাইনে মুসলমানদের কচুকাটা করা হচ্ছে, রক্তবন্যায় প্লাবিত হচ্ছে সেখানকার জনপদ, নাফ নদীর পানি রক্ত আর লাশে একাকার; মানবতাবিরোধী যত অপরাধ হতে পারে সবই সেখানে সংঘটিত হচ্ছে, তবুও নীরব তথাকথিত বিশ্ববিবেক।
গণহত্যা ও ব্যাপক নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েক দিন পর্যন্ত পানির ¯্রােতের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকেছে। ইতোমধ্যে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রথমে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকলেও পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি গোটা দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা। রাখাইন এখন প্রায় মুসলিম শূন্য। সেখানে সব ধর্মীয় স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার মুসলমানকে। এমন কোনো যুবতি নারী নেই যাকে ধর্ষণ করেনি বর্মি সেনারা।
যে ছুতায় রোহিঙ্গা নিধন
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে ‘দ্য অ্যাডভাইজারি কমিশন অব রাখাইন স্টেট’ নামে একটি কমিশন গঠন করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সু চি। কমিশনের নয় সদস্যের মধ্যে ছয়জন মিয়ানমানের নাগরিক এবং কফি আনানসহ তিনজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। এই কমিশন দীর্ঘ এক বছর অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে করে গত ২৩ আগস্ট ২০১৭ একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে তারা সচেতনভাবে ‘বাঙালি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ উভয় শব্দ পরিহার করে এর পরিবর্তে ‘মুসলিম কমিউনিটি অব রাখাইন’ শব্দটি ব্যবহার করে। কমিশন সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ১২ ইস্যুতে ৮৬টি সুপারিশ করে। এই কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি মুসলমানদের পক্ষে না গেলেও এটা বাস্তবায়ন হলে অন্তত কিছু অধিকার ফিরে পেত রোহিঙ্গারা। এই কমিশন বাস্তবায়নের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
আনান কমিশন বাস্তবায়নের দাবি ওঠার পরপরই রোহিঙ্গা নিধনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। গত ২৫ আগস্ট ভোররাতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি সংক্ষেপে ‘আরসা’ নামের একটি বিদ্রোহী সংগঠন সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালায় বলে অভিযোগ তুলে মিয়ানমার সরকার। এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। আর ‘আরসা’ কারা, এটা মিয়ানমার সরকারের বানানো কোনো ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ কি না এটা নিয়েও রয়েছে নানা কথা। এই ছুতা ধরেই চলে মূলত রাখাইনে চলছে গণহত্য। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে সেনাবাহিনী, সঙ্গে রয়েছে উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী।
শোষিত-বঞ্চিত রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের আরাকানে (বর্তমানে রাখাইন প্রদেশ) হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানদের বাস। ওই অঞ্চলে নৃতাত্ত্বিক ও স্থানীয় কিছু ঐতিহ্যের কারণে তারাই রোহিঙ্গা নামে খ্যাত। বেশ কয়েকবার এ এলাকাটি আক্রান্ত হয়, স্বাধীনতা হারায়, নির্যাতিত হয়। সে হিসেবে আরাকানে মুসলিম নিধন ও নির্যাতন অনেক পুরানো একটি বিষয়। তবে গত পৌনে এক শতাব্দীকালে এই নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেড়েছে। ১৯৩৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মুসলিমদের টার্গেট করে শতাধিক ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সহিংসতা ও সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ‘বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত কয়েক দশক ধরে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকছে। রোহিঙ্গাদের জোর করে বৌদ্ধধর্ম পালনে বাধ্য করা হয়। মুসলিম স্থাপনাসমূহ রাখাইন বৌদ্ধরা দখল করে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় বৌদ্ধদের আক্রমণে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। মিয়ানমারে মিডিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর সিকিভাগও আমরা জানতে পারছি না।
রোহিঙ্গারাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি দেশটির সরকার। ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গারা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। মিয়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হলো ভারতীয়, বাঙালি ও চাটগাঁইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই রোহিঙ্গারা আরাকানে আসে এবং জাতি হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। এক সময় স্বাধীন আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য ছিল। মিয়ানমার পার্লামেন্টে বেশ কয়েকজন মুসলিম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেনও। তবুও গায়ের জোরে এখন মিয়ানমার কোনো যুক্তিই মানছে না, যেকোনো মূল্যে রাখাইন রাজ্যকে মুসলিমশূন্য করাই তাদের প্রধান টার্গেট। ইতোমধ্যে সে টার্গেটে তারা অনেকটা সফল।
বিশ্বমোড়লদের মুখে কুলুপ
মিয়ানমারে এতো হিং¯্রতা ও বর্বরতা চললেও কোনো শোরগোল নেই বিশ্বমোড়লদের। তারা যেন এর কিছুই দেখছে না। কথিত শান্তির ধ্বজাধারীদের কর্ণকুহরে পৌঁছছে না মিয়ানমারের নিপীড়িত মানতার আর্তচিৎকার। বিশ্বমিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্বরতার চিত্র প্রকাশ হলেও কোনো মোড়লই এ ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছে না। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ভারত সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে তারাই মুসলিম নিধনের ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্রিটেন এর বিরুদ্ধে কিছু বললেও তা খুব জোরালো নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা আরও বেশি হতাশাজনক। একমাত্র তুরস্ক ছাড়া কেউ এই ইস্যুতে সোচ্চার নয়। মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরব কাতারের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ কার্যকরে আদাজল খেয়ে লাগলেও মুসলিম গণহত্যার বিরুদ্ধে নেই তাদের কোনো বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
মুসলিম বিশ্বের ‘টুটো জগন্নাথ’ মার্কা একটি সংগঠন আছে ওআইসি। গণহত্যা চালিয়ে মুসলিমশূন্য করে দিলেও এর নেই কোনো টু শব্দ। জাতিসংঘের অধিবেশনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মুসলিম বিশ্বের নেতাদের রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এতে ক্ষমতার মদমত্তে অন্ধ আরব শাসকদের ঘুম যে ভেঙেছে তা মনে হয়নি। ওআইসিরও এ ব্যাপারে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী নিধনের শিকার হলেও তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। একমাত্র রিসেপ তায়েব এরদোয়ান ছাড়া মিয়ানমারকে ধমকের সুরে কথা বলবে এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসক মুসলিম বিশ্বে নেই।
মানবতার বুলি আওড়িয়ে বেড়ায় যেসব পশ্চিমা দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের অবস্থান খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সুস্পষ্ট এই মানবতাবিরোধী অপরাধ চললেও বিশ্ববিবেক এ ব্যাপারে কোনো রা করছে না। তারা যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। এর একমাত্র কারণ হলো যাদেরকে কচুকাটা করা হচ্ছে তারা মুসলমান। আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে কথিত মানবাধিকার কখনোই কার্যকর হয় না। মুসলমানদের ওপর যত নিপীড়নই চলুক এটা প্রচলিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে না। এজন্য দেড় লাখ লোকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্বতিমুরের স্বাধীনতার জন্য তারা সবকিছু করতে পারলেও আট লাখ লোকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরাকানের স্বাধীনতা তারা চায় না। কারণ পূর্বতিমুরের আন্দোলনকারী ছিল খ্রিস্টান আর আরাকানে নিষ্পেষিত হওয়া মানুষেরা মুসলমান।
শান্তির দূত আর অহিংস জাতির এই অবস্থা?
মিয়ানমারে এখন ক্ষমতায় আছে শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন সরকার। এই গণহত্যা ও নির্যাতনের পেছনে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। একসময় গণতন্ত্র ও শান্তিকামী নেত্রী হিসেবে সু চি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও এখন তিনি ধিকৃত। সারাবিশ্বের ঘৃণা এখন তার প্রতি। সম্প্রতি তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানেও তিনি মুসলিম রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো কথা তো বলেননি, এমনকি বিশ্ব চাপকে পরোয়া করেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে কোনো নির্যাতন হয়নি বলেও দাবি করেছেন। একজন নোবেলজয়ী মানুষের মুখে এমন নির্জলা মিথ্যা শুনে সারাবিশ্ব আজ হতবাক। ক্ষমতা মানুষকে এতোটা নিচে নামিয়ে দিতে পারে সেটা সু চিকে না দেখলে বিশ্ববাসী জানতো না। সারা বিশ্ব থেকে এখন দাবি উঠেছে এমন গণহত্যার সহযোগী নেত্রীর হাতে নোবেল মানায় না।
একটি বিষয় বলার চেষ্টা করা হয় যে, আসলে সু চির করার কিছু নেই। মিয়ানমারের সরকার চালায় মূলত দেশটির সেনাবাহিনী। সংসদে ও সরকারে সেনাবাহিনী সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এর কোনো ভিত্তি নেই। সু চি কিছু করতে চাইলে অবশ্যই করতে পারতেন। যাকে শান্তির জন্য নোবেল দেয়া হলো তিনি কীভাবে এতো অশান্তির কারণ হতে পারেন? তার মধ্যে সামান্য নৈতিকতাটুকু থাকলেও তিনি প্রয়োজনে সরকার থেকে সরে দাঁড়াতেন। কারণ ক্ষমতা চিরদিনের জন্য নয়, কিন্তু ভালো কাজের জন্য মানুষ চিরদিন স্মরণ রাখে।
মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ। গোবেচারা টাইপের একটি ধর্ম হিসেবে এটি সারা বিশ্বে পরিচিত। এই ধর্মের মূল বাণী হচ্ছে অহিংসা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধ আজীবন শান্তির বাণী বিলিয়ে গেছেন। জীবহত্যা মহাপাপ যে ধর্মের মূল স্পিরিট সেই ধর্মের মানুষেরা এখন মানুষ হত্যার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। গণহত্যা বহু দেশেই হয়ে থাকে। এক বোমায় হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষ মারার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু জীবন্ত মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে, বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মানুষ মারার এমন ঘটনা আগে আর ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওয়াল ভরে গেছে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা ও নির্যাতনের বীভৎস চিত্রে। প্রকাশ্যে মানুষকে জবাই করে হত্যার ভিডিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। একজন জীবন্ত মানুষকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে আলাদা করার ভিডিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষত-বিক্ষত কত লাশ যে রাখাইনের পথেঘাটে পড়ে আছে এর কোনো হিসাব নেই। প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে নির্যাতনের বিবরণ শুনলে কারও পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশিদের মানবতাবোধ সারাবিশ্বে প্রশংসিত
আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্তত পুরো জাতি একটি জায়গায় এসে এক হতে পেরেছি। আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি, হেফাজত থেকে গণজাগরণ মঞ্চ সবাই মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে। এজন্য প্রথমে সরকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করলেও জনগণের ভাষা বুঝতে পেরে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে আগে থেকে আছে আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। সীমিত সম্পদের টানাপোড়েনের একটি দেশে অন্য দেশের আট লাখ মানুষকে আশ্রয় এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা নিশ্চয় সামান্য বিষয় নয়। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, ষোল কোটির খাবারের ব্যবস্থা হলে আট লাখেরও হবে। এটা অনেক বড় মনের কথা। এই জন্য দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তিতে তাকে নোবেল দেয়ার দাবি উঠেছে এবং সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে এসেছে সেই নাম। এটা অবশ্যই আমাদের দেশের জন্যও গর্বের বিষয়।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের এভাবে আশ্রয় দেয়াই কোনো সমাধান নয়। কারণ সরকার এখানে তাদেরকে আশ্রয় দিলেও তারা কখনও এই দেশের নাগরিক হতে পারবে না। এজন্য তাদেরকে নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে যাতে তারা তাদের জনগণকে ফিরিয়ে নেয়। নিজ দেশের জনগণ অন্য কোনো দেশে গিয়ে শরণার্থী হয়ে থাকবে এটা মর্যাদাসম্পন্ন কোনো রাষ্ট্রের কখনও কাম্য হতে পারে না। আয়তনে বিশাল, সম্পদেও মোটামুটি অবস্থানে থাকা মিয়ানমারের জন্য এই নাগরিককে ফিরিয়ে নেয়া কোনো বিষয়ই নয়। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। অসভ্যতার চরম নজির স্থাপনকারী একটি দেশ এখন এই আন্তরিকতাটুকু দেখাবে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। তবে সবকিছুর পর রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে পেতে হলে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের কোনো বিকল্প নেই। যতদিন আরাকান স্বাধীন না হবে ততদিন তাদের দুর্ভোগ পোহাতেই হবে।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এর একটি প্রশ্ন সেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অধিবেশনের একটি পর্বে উত্থাপন করেছেন। সেই প্রশ্নটি হলো সারাবিশ্বে শুধু মুসলমানরাই কেন শরণার্থী হয়, অন্য কোনো ধর্মের শরণার্থীর কথা তো আমরা শুনি না। তাহলে কি পরিকল্পিতভাবেই সারাবিশ্বে মুসলমানদের ছন্নছাড়ার একটি পরিকল্পনা কার্যকর আছে? এই প্রশ্নের জবাব জাতিসংঘের অধিবেশনে কেউ দিতে পারেনি। এটা কেউ দিতে পারবেও না। তবে এ কথা সুস্পষ্ট যে, বিশ্বে আজ সবচেয়ে নিগৃহীত জাতি মুসলমানরা। চারদিকে শুধু তাদের ওপরই চলছে নিপীড়ন। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কিংবা বুকটান করে সামনে চলার মতো অবস্থায় যেন মুসলমানরা কখনো পৌঁছাতে না পারে সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। ‘আল-কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’ তথা সমস্ত কুফুরি শক্তি এক হিসেবে সবাই মিলেই মুসলমানদের দমিয়ে রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত।
সুতরাং কোনো জাতিসংঘ আর কোনো সংস্থা মুসলমানদের ভাগ্য ফেরাতে পারবে না। তাদেরকে নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই ফেরাতে হবে। ভাগ্য কীভাবে ফেরাতে হবে সে কথা আল্লাহ কোরআনে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না, তোমরা ভীত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও।’ আমরা কি প্রকৃত মুমিন হতে পেরেছি সেটা পর্যালোচনার সময় এসেছে। তাছাড়া মুসলমানদের এই অধঃপতনের কারণ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সা. ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। বলে গেছেন, যখন তোমরা জিহাদ ছেড়ে দেবে তখন আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছনা আরোপ করে দেবেন। যেদিন থেকে মুসলমানরা খেলাফতব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেদিন থেকেই তাদের ওপর পুঁথির দানার মতো নানা দুঃখ-দুর্দশা পতিত হচ্ছে। বীরের জাতি আবার বীরের মতো ঘুরে দাঁড়ালে কেউ নেই মুসলমানদের সামনে দাঁড়ানোর মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য একটাই, কে দেবে সেই সাহস! কে বসবে মুসলিম জাতির নেতৃত্বের আসনে!
আরেকটি প্রশ্ন হলো, দেশে দেশে প্রতিবাদী মুসলিমদের ‘জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার আন্তর্জাতিক একটি এজেন্ডা কার্যকর রয়েছে। মুসলমান কেউ তার অধিকার আদায়ের জন্য একটু সহিংস পথ বেছে নিলে বিশ্বমিডিয়ায় ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ হিসেবে ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু মিয়ানমারে যে বর্বরতা চলছে, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরকে তো কেউ জঙ্গি বলছে না? তাহলে কি জঙ্গি শব্দটি শুধুই মুসলমানদের ঘায়েল করার একটি অস্ত্র! নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে একজন মুসলমান ‘জঙ্গি’ হিসেবে ধিকৃত হলে প্রকাশ্য গণহত্যা চালানোর পরও কেন বৌদ্ধদের জঙ্গি বলা যাবে না? আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কোথাও তাদেরকে জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এতেই বোঝা যায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোও বুঝে না বুঝে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করাকেই প্রগতি মনে করছে।